উলুমুল ফিকহ

উলুমুল ফিকহ

     ভূমিকাঃ- ইসলাম মহান আল্লাহ প্রদত্ত রাসুল (সঃ) প্রদর্শিত মানব জাতির জন্য একমাত্র পূর্ণাঙ্গ শান্তিপূর্ণ জীবন বিধান। এতে মানুষের জীবনের সকল দিক ও বিভাগের যাবতীয় সুন্দরতম সমাধান নিহিত রয়েছে। ইসলামের প্রধান উৎস পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ। আর এ কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক বিধানগুলোর সমসাময়িক পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে স্থান-কাল পাত্রভেদে বাস্তব অবস্থার আলোকে প্রায়োগিক রূপ দিয়েছে যে শাস্ত্র,তার নাম হল "ইলমুল ফিকহ।" আল্লাহর রাসুল (সঃ) বলেছেন-"প্রত্যেক বস্তুর স্তম্ভ আছে,আর এ দ্বীনের স্তম্ভ হলো ফিকহ" এর জ্ঞান শিক্ষা করা ফরযে আইন ও ফরযে কেফায়া। হিজরী ১০ সাল পর্যন্ত ফিকহ শাস্ত্র ছিল মহা নবী (সঃ)-এর জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। এ সময় সকল সমস্যার সমাধান ওহীর ভিত্তিতে তিনি নিজেই করতেন। পরবর্তীতে সত্যপন্থি মুজতাহিদগন নিজ প্রজ্ঞা ও বুদ্বির সাহায্যে আন্তরিক ও একনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাতের জন্য  পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে সমস্যার সমাধান খুজে বের করেন। পরবর্তীতে ইমাম আবু হানিফা (র), ইমাম মালিক (র) সহ অনেকেই এ কাজে আত্ননিয়োগ করেন। মূলত এ যুগেই ফিকহ শাস্ত্র সংকলনের কাজ শুরু হয়। নিন্মে ফিকহের বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

      ফিকহ শাস্ত্রের শাব্দিক পরিচয়ঃ- ফিকহ শব্দটি আরবী,এর শাব্দিক অর্থ উন্মোচন করা,স্পষ্ট করা, উপলব্ধি করা, অনুধাবন করা, জানা, বুঝা, চিন্তা, গবেষণা ইত্যাদি। যেমন কোরআনে এসেছে-"তাদের অন্তর রয়েছে, তবে তাদ্বারা তারা উপলব্ধি করেনা" আরাফ-১৭৯।

      ইলমে-ফিকহ-এর পারিভাষিক পরিচয়ঃ- ইসলাম স্বীকৃত বিধি-বিধানের সমষ্টি হচ্ছে ফিকহ। সহজ ভাষায় বলা যায় "যে বিষয় অধ্যয়ন করলে বিস্তারিত দলিল প্রমানের ভিত্তিতে শরিয়তের বিধিবিধান সঠিক ও স্পষ্টভাবে জানতে পারা যায় তাকে ইলমুল ফিকহ বলে।

কারো মতে, যে শাস্ত্রের মাধ্যমে আদিল্লায়ে মুফাসসালা (তথা কুরআন,সুন্নাহ,ইজমা ও কিয়াস) হতে শাখাগত শর‍য়ী বিধান সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়, তাকে ইলমে ফিকহ বলে।

আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রঃ) বলেন- কুরআন,সুন্নাহ হতে বিবেক-বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞাবকে ইলমে ফিকহ বলে।

      ইলমে ফিকহ-এর আলোচ্য বিষয়ঃ- মুকাল্লাফ(তথা শরয়ী বিধান প্রবর্তিত) ব্যক্তির, কার্যকলাপ। অর্থাৎ মানুষের জন্ম হতে মৃত্যু এবং সমাহিত হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,আধ্যাত্নিক ইত্যাদি সার্বিক কার্যকলাপ নিয়ে এতে আলোচনা পর্যালোচনা করা হয়। সুতরাং মানুষের সার্বিক কর্ম-কান্ডই এর আলোচ্য বিষয়।

      ইলমে ফিকহ-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ- ইলমে ফিকহ অধ্যয়নের লক্ষ্য হলো নিজে আমল করা, আল্লাহর বান্দাগণকে অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে আনয়ন করাএবং আমলে অভ্যস্ত করা। উদ্দেশ্য হলো শরীয়তের যাবতীয় আহকাম সর্বসাধারণের কল্যানে প্রকাশ করে, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

     ইলমে ফিকহ- এর হুকুমঃ- ইলমে ফিকহ শিক্ষা করা ফরযে আইন ও ফরযে কিফায়া। যতটুকু জ্ঞান অর্জন দ্বারা ব্যক্তি জীবনে জরুরী বিষয়াদির অবগতি লাভ করা যায় ততটুকু পরিমাণ জ্ঞানলাভ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরযে আইন। আর এর অতিরিক্ত অন্যের কল্যাণ সাধনকল্পে জ্ঞানলাভ করা ফরযে কিফায়া। বাকী ইলমে ফিকহের সার্বিক বিষয়াদি নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ, বিবাহ তালাক প্রভৃতি বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্যার্জন করা সুন্নাত বা মুস্তাহাব। আর প্রত্যেকে যে যে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চায় তার জন্য উক্ত বিষয়ে আবশ্যকীয় মাসায়েল অবগত হওয়া ওয়াজিব।

     ইলমে ফিকহ-এর প্রয়োজনীয়তাঃ- ইলমে ফিকহের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য ইসলাম যেহেতু একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও কল্যাণকর জীবন-ব্যবস্থা, সেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত সমসাময়িক যুগের পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে "ইজতিহাদের" মাধ্যমে ইসলামী শরী'আতের হুকুম আহকাম, আইন-কানুন ও বিধি-নিষেধ উদ্ভাবন, প্রবর্তন ও ও প্রতিষ্ঠা করা শর'ঈ প্রয়োজন। এর মাধ্যমে পরিস্থিতির প্রয়োজন পূরন করার জন্য প্রদত্ত ব্যাখ্যাসমূহের মধ্য থেকে একটিকে অগ্রাধিকার প্রদান করে মানবতার জন্য প্রমাণিত কল্যাণধর্মী বিধান হিসেবে কার্যকর করা।

    উসূলে ফিকহের পরিচয়ঃ- উসূল অর্থ নিয়ম নীতি,  প্রমান, অগ্রগণ্য ইত্যাদি। আর ফিকহ অর্থ স্পষ্ট করা খোলা ইত্যাদি।

আল্লামা নিযামুদ্দীন বলেন- উসূলে ফিকহ এমন কতগুলো নীতিমালা শিক্ষা করাকে বলে যেগুলো দ্বারা শরীয়তের হুকুম আহকাম পুঙ্খানু-পুঙ্খ প্রমাণ দ্বারা উদঘাটনে সাহায্য করে।

   * বিস্তারীত দলীল সমুহ হতে উদ্ভাবিত আমল সম্পর্কিত বিধানসমুহ যে শাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে তাকে ফিকহ বলে। আর ইলমে ফিকহের নীতিমালা ও দলিল প্রমাণ যে শাস্ত্রে আলোচিত হয় তাকে উসূলে ফিকহ বলা হয়।

   উসূলে ফিকহের লক্ষ্য ওউদ্দেশ্যঃ- উসূলে ফিকহের লক্ষ্য হলো শরীয়তের বিধানাবলীকে বিস্তারীত দলীল প্রমাণের আলোকে উপলব্দি করা এবং মাসায়েল উদ্ভাবন করে সঠিক নীতিমালার জ্ঞাণ লাভ করা। উদ্দেশ্য হলো তদানুযায়ী বিশুদ্ধ আমলের মাধ্যমে দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি লাভ করতঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

      ইলমে ফিকহ-এর উৎসঃ- রাসুল (সঃ)-এর সময়ে যে দু'টি উৎস থেকে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, আইনের সে দু'টি উৎস হলো-আল-কোরআন ও সুন্নাত। পরবর্তীতে ইসলামী চিন্তাবিদ ও নির্ভরযোগ্য মনীষীগন কর্তৃক ইলমুল ফিকহ এর উৎস হিসেবে আরো দু'টি বিষয়কে বিবেচনা করা হয়। তা হলো- ইজমা ও কিয়াস।

   ১। আল-কুরআনঃ-মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে রাসুল (সঃ)-এর নবুয়াতী জীবনের ২৩ বছরে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল হয়, প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন অবস্থা ও ঘটনাকে কেন্দ্রুকরে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত নাযিল হয়। যা তিলাওয়াত করা ইবাদত। তাই আল-কুরআন ইলমে ফিকহের প্রথম ভিত্তি। তবে তা কুরআনের সকল আয়াতকে বুঝায় না। বরং কুরআনের ৫০০ আয়াতের মাধ্যমে সরাসরি দলিল হিসেবে উসূলে ফিকহ শাস্ত্রবিদগণ হুকুম আহকাম প্রতিষ্ঠা করনে ব্যবহার করেন।

   ২। সুন্নাতঃ- পবিত্র আল-কুরআনের ব্যাখ্যাস্বরুপ (কুরআন ব্যতিরেকে) রাসুল (সঃ) যা কিছু বলেছেন, করেছেন এবং সমর্থন করেছেন তার সবই সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। অসংখ্য হাদীস থেকে ৩০০০ হাদীস আহকামের দলীল হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

   ৩। ইজমাঃ- ইজমা হল জাতির বিশেষজ্ঞদের ঐক্যমত। অর্থাৎ কোন সমস্যার সমাধান আল-কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে পাওয়া না গেলে তার সমাধানের জন্য সমসাময়িক যুগের প্রধান আলিম ও ইসলামী আইনজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্মিলিতভাবে কুরআন-সুন্নাহর মৌলণীতির আলোকে কোন একটি একক সিদ্বান্তে উপনীত হওয়াকে ইজমা বলে। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন-"এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্যে এবং যাতে রসূল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য"(বাকারা-১৪৩)এর উপর আমল করা ওয়াজিব।

   ৪। কিয়াসঃ- কিয়াস অর্থ তুলনা করা বা তুলনামূলকভাবে বিবেচনা করা। যদি কুরআন হাদীস ও ইজমাতে কোন সমস্যার সমাধান না পাওয়া যায় তবে কুরআন ও হাদীসের অনুরূপ কোন সমাধান থেকে তুলনা করে সমস্যার সমাধান করাকে 'কিয়াস' বলে। রাসুল (সঃ)-এর জীবন থেকেই কিয়াসের প্রমান পাওয়া যায়। যেমন হযরত আমরের কিয়াসের ঘটনা।

     কুরআনের আলোকে ইলমে ফিকহঃ-  আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-  

فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

  অর্থাৎ তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে। (১২২-তাওবা)

অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন- يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ   অর্থাৎ তিনি যাকে ইচ্ছা বিশেষ জ্ঞান দান করেন এবং যাকে বিশেষ জ্ঞান দান করা হয়, সে প্রভুত কল্যাণকর বস্তু প্রাপ্ত হয়। উপদেশ তারাই গ্রহণ করে, যারা জ্ঞানবান। (২৬৯-বাকারা)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন- فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ অর্থাৎ যদি তোমাদের জানা না থাকে তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, (নাহল-৪৩)

এ সকল আয়াতে ক্রমানুসারে- َتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ  (দ্বীনি জ্ঞান), الْحِكْمَةَ  (প্রজ্ঞা) দ্বারা ফিকহ শাস্ত্র ও أَهْلَ الذِّكْرِ  দ্বারা ফিকহ শাস্ত্রবিদ বুঝান হয়েছে।

     হাদীসের আলোকে ইলমে ফিকহঃ- রাসূল করীম (স) এরশাদ করেছেন-

     ১। প্রত্যেক বস্তুর স্তম্ভ আছে, আর দ্বীনের স্তম্ভ হলো ফিকহ।

     ২। একজন ফকীহ শয়তানের নিকট সহস্র মূর্খ আবেদের চেয়ে অধিক কঠিন।

     ৩। ফিকহের বৈঠক ষাট বৎসরের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেয়।

     ৪। আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।

     ইজতিহাদঃ- যে সকল নতুন উদ্ভূত সমস্যার সমাধান পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সরাসরি পাওয়া যায় না, তার সমাধান কুরআন ও সুন্নাহর মূলনীতি অনুসরণ করে বের করে নেয়ার জন্য একনিষ্ঠ সাধনাকেই "ইজতিহাদ" বলা হয়। যারা "ইজতিহাদের" কাজ করেন তাদেরকে "মুজতাহিদ" বলা হয়। রাসুল (স)-এর জীবনেই কোন কোন বিষয়ে তিনি নিজেই "ইজতিহাদ" করেছেন। তাঁর 'ইজতিহাদ' কখনো আল-কুরআনের আয়াত দ্বারা সমর্থিত হয়েছে আবার কখনো কখনো আল্লাহ আরও আধিক কল্যাণকর কোন সিদ্বান্ত দ্বারা রাসূল (স) কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থাকে রদ করেছেন। বস্তুত রাসুল (স) কর্তৃক সম্পাদিত 'ইজতিহাদ' সাহাবীগণ এবং তৎপরবর্তী যুগের মুসলিমদের জন্য অনুসরণীয় উদাহরণ স্থাপন করেছে এবং ইজতিহাদের বৈধতা প্রদান করেছে। যাতে কোন বিষয়ে কুরআন এবং সুন্নাতে সুস্পষ্ট আইনগত সিদ্বান্ত পাওয়া না গেলে তারা নিজেরাই ইজতিহাদের মাধ্যমে  সিদ্বান্ত গ্রহন করতে পারেন।

      ইজতিহাদের শর্তঃ- ইজতিহাদ সঠিক ও নির্ভরযোগ্য হওয়ার জন্য মুজতাহিদকে নিন্মোক্ত শর্তাবলী পূরন করতে হবে-

     * আল-কুরআনের জ্ঞানঃ- মুজতাহিদকে অবশ্যই পবিত্র কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী হতে হবে, আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট ও কারনসমুহ সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখতে হবে এবং এ সম্পর্কিত তাফসীর ও তাবীল আলোচনার উপর তার সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে,আহকামের আয়াত সম্পর্কে তিনি অভিজ্ঞ হবেন।

     * আল-হাদীসের জ্ঞানঃ- মুজতাহিদকে অবশ্যই সুন্নাতুর রাসূল (স) সম্পর্কিত 'ইলমে' পারদর্শী হতে হবে। ইসলামী শরীয়তের হুকুম আহকাম যে সকল হাদীস থেকে চয়ন করা হয়েছে, হাদীস শাস্ত্রের বর্ণনা পরস্পরার স্তরসমুহ, সহীহ, য'ঈফ, মুতাওয়াতির, মাশহুর, হাসান সম্পর্কে সম্যক ধারনা নিয়ে আহকাম উদ্ভাবনের পদ্বতিসমুহ সম্পর্কে দক্ষতা থাকতে হবে। এবং আহকাম সংক্রান্ত হাদীসসমুহের উপর পূর্ণ অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

    * আরবী ভাষায় দক্ষতাঃ- মুজতাহিদকে অবশ্যই আরবী ভাষায় দক্ষ ও পারদর্শী হতে হবে। একজন আরবীভাষী যেভাবে তা বুঝেন সেভাবে মুজতাহিদেরও আরবী ভাষা বুঝার শক্তি থাকতে হবে যাতে তিনি আরবী ইবারতের অর্থ ও উদ্দেশ্য, বিশেষ অর্থ বুঝতে পারেন ও তার ভিত্তিতে সঠিক মতামত পেশ করতে পারেন।

    * উসূলে ফিকহের জ্ঞাণঃ- মুজতাহিদকে উসূলে ফিকহের উপর গভীর জ্ঞাণী হতে হবে। উছুলে ফিকহের ব্যাপক নিয়মাবলী, নাসেখ (যে দলীল দ্বারা অন্য দলীলকে রহীত করা হয়েছে), মানসূখ(যাকে রহিত করা হয়েছে), আ'ম (সাধারণ ও ব্যাপক অর্থ), খাস (বিশেষ ও সংক্ষিপ্ত অর্থ), মুতলাক্ব (বাধাহীণ সাধারণ অর্থ), মুক্বায়্যেদ (সীমাবদ্ব ও শর্তযুক্ত অর্থ), মুজ্বমাল (সার-সংক্ষেপ), মুবায়্যেন (বিস্তারিত স্পষ্ট অর্থ), এস্তেহসান (উত্তম বিবেচনায় অনুমোদন), উরফ (প্রচলিত রীতি), বিপরীত অর্থ  ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারীত জানতে হবে।

    * ইসলামী আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কিত জ্ঞাণঃ- মুজতাহিদকে ইসলামী আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে জ্ঞাণী হতে হবে। এর অন্তর্নিহিত প্রভাব ও লক্ষ্যসমূহ জানার সাথে সাথে সাধারণ মানুষের কল্যাণ কিসে এবং তাদের প্রচলিত রীতিসমূহের কল্যাণকর বিষয় কী কী তাও তাকে রপ্ত করতে হবে।

     * ইজমা সম্পর্কিত জ্ঞানঃ- মুজতাহিদ যে সকল বিধান সম্পর্কে ইজমা হয়েছে তার সার্বিক বিষয়ে অবগত হবেন, যাতে করে উম্মত কর্তৃক ঐকমত্য পোষণকারী বিষয়ের পরিপন্থী কোন পদক্ষেপ না নেন।

    * কিয়াস সম্পর্কিত জ্ঞাণঃ- মুজতাহিদকে 'কিয়াস' বা (কুরআন ও সুন্নাহর আহকামসমূহের) তুলনা বিভাগসমুহের পর্যাপ্ত জ্ঞাণ থাকতে হবে। যে উদ্দেশ্যে শরীয়াতের হুকুমসমুহ প্রবর্তন করা হয়েছে তা জানতে হবে। মানব সমাজের সত্যিকার কল্যাণের জন্যে যেসকল বিষয়ের উপর সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহর উদ্বৃতি নেই তার স্থলে "কিয়াস" করে হুকুম বের করার পদ্বতি জানা থাকতে হবে।

     * সাহাবী ও তাবেয়ীদের ইজতিহাদ সম্পর্কিত জ্ঞানঃ- মুজতাহীদকে অবশ্যই সাহাবী ও তাবেয়ীগণ যে সকল নীতিমালার ভিত্তিতে সিদ্বান্ত প্রদান করেছেন সে সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত হতে হবে। বিশেষ করে খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় সাহাবায়ে কিরামের ইজতিহাদ, ইজমা ও তার পটভূমি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে।

    * তাকওয়া তথা আল্লাহভীরুঃ- মুজতাহিদকে উত্তম মেজাজের আল্লাহভীরু হতে হবে। এবং যিনি কখনও ইচ্ছাকৃত কবীরা গুনাহ করেননি ও ছগীরা গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকেননি এবং ভদ্রতা ও শিষ্টাচারী চরিত্রের বিপরীত কোন কাজে জড়িয়ে পড়েননি তিনিই মুজতাহিদ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

    ফিকহী বিধান ও তার প্রকারঃ-  ইসলামী শরীয়ত মূলত দুই প্রকার। অর্জনীয় ও বর্জনীয়। এখানে বিস্তারীত বর্ণনা দেওয়া হলো-

   অর্জনীয় আমল ও তার প্রকারঃ- অর্জনীয় আমল দুই ভাগে বিভক্ত-

   ক। আযীমত (আবশ্যিক) এমন বিধান যা মৌলিকভাবে পালন উদ্দেশ্য, সংশ্লিষ্টরূপে নয়।

   খ। রুখসাত (শীথিলতা সম্পন্ন) এমন কাজ উদ্দেশ্য যা ক্ষেত্র বিশেষে পালনের হুকুমে শীথিলতা সম্পন্ন।

আযীমত (আবশ্যিক) আমল সমূহঃ-

   ১। ফরযঃ- ফরয অর্থ আবশ্যক, সাব্যস্তকরন, সীমাবদ্ধকরণ ইত্যাদি। পরিভাষায়, শরীয়তের অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত আবশ্যকীয় বিষয়কে ফরয বলে। অর্থাৎ যে বিষয়গুলোকে অতি জরুরী হিসেবে আদায় করার জন্য হুকুম করা হয়েছে। যেমন- নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ ইত্যাদি।

ফরয দু'ই প্রকার। যথা-

   (ক) ফরযে আইনঃ- যে কাজগুলো সকল মুসলিমের জন্য পালন করা জরুরী। যেমনঃ- নামাজ আদায় করা, পর্দা মেনে চলা।

   (খ) ফরযে কিফায়াঃ- যা পালন করা সকলের ওপর অত্যাবশ্যক নয়। কিছু সংখ্যক লোক আদায় করলেই সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। যেমন- জানাযার নামাজ, হাসপাতাল তৈরি করা, ডুবন্ত ব্যক্তিকে রক্ষা করা, অগ্নি নির্বাপন করা ইত্যাদি। উভয় ফরয অস্বীকারকারী কাফের ও ফাসেক হিসেবে বিবেচিত হবে।

   ২। ওয়াজিবঃ- যে কাজ করা জরুরী তবে ফরযের মত নয়, যেমন- বিতর ও দু'ই ঈদের নামাজ আদায় করা ইত্যাদি।

   ৩। সুন্নাতঃ- সুন্নাত অর্থ তরীকা, রীতি-নীতি, প্রথা। যে সকল কাজ রাসুল (স) (পালন অত্যাবশ্যকীয় না হওয়া সত্ত্বেও) পালন করতেন এবং মাঝে মাঝে পরিত্যাগ ও করেছেন তাকে সুন্নাত বলে। যেমন- উমরা আদায় করা, যোহরের ফরযের পূর্বে চার রাকায়াত সুন্নাত আদায় করা ইত্যাদি।

    সুন্নাত দুই প্রকার। যথা-

    (ক) সুন্নাতে মুয়াক্কাদাঃ- যা রাসুল (স) সর্বদা পালন করেছেন, এবং অন্যকে তা পালন করার জন্য বলতেন। যেমন- ফজরের পূর্বে দু'ই রাকাআত, যোহরের পরে, মাগরিবের পরে এবং এশার পরে দু'রাকাআত করে নামাজ আদায় করা।

   (খ) সুন্নাতে যায়িদাহ বা গায়রে মুয়াক্কাদাঃ- রাসুল (স) যা অধিকাংশ সময় পালন করেছেন। কখনো কখনো পরিত্যাগ করেছেন। যেমন- আসর ও ইশার নামাজের পূর্বে চার রাকায়াত আদায় করা।

    ৪। নফলঃ- নফলের শাব্দিক অর্থ অতিরিক্ত। ফরয ও ওয়াজিবের অতিরিক্ত সকল আমলই নফল হিসেবে বিবেচিত। এ হিসাবে এটা সুন্নাতের উভয় প্রকার শামিল করে।

ইসলামী শরীয়াতের ফকীহগণ আরো কিছু আমলের আলোচনা করে আল্লাহর আনুগত্যকে আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন।

    মুস্তাহাবঃ- ঐ সকল কাজ যা আদায় করাকে পছন্দ করা হয়েছে না করলে কোন অপরাধ ধরা হয়নি, যেমন- যোহর,মাগরিব ও ইশার নামাযের পর দু'রাকায়াত নফল নামাজ আদায় করা ইত্যাদি।

   ৬। হালালঃ- হালাল হল বৈধ কাজ, যেমন- উট, দুম্বা, গরু ও ছাগলের গোশ্ত খাওয়া এবং এগুলোর দুধ পান করা ইত্যাদি।

   ৭। মুবাহঃ- মুবাহ ঐ সকল কাজ যা বৈধ। যেমন, কৃষি কাজ, ব্যবসা বাণিজ্য করা ইত্যাদি।

    বর্জনীয় আমলের প্রকারভেদঃ- বর্জনীয় বা নিষিদ্ধ আমল দুই প্রকার। যথা-

   ১। হারামঃ- যা অকাট্য ও স্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণিত। যেমন- মদ্যপান করা, ব্যবিচার করা, সুদ, শুকরের গোস্ত খাওয়া ইত্যাদি।

   ২। মাকরূহঃ- যা অপছন্দনীয় হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। যেমন- ফাসিক ও বিদ'আতী লোকের ইমামত করা, খালি গায়ে নামাজ আদায় করা ইত্যাদি।

মাকরূহ দু'প্রকার। যথা-

    মাকরূহে তাহরিমীঃ- যে কাজগুলো অধিক অপছন্দনীয় কিন্তু হারাম নয়। যেমন কচ্ছপ খাওয়া, কবরস্থানকে অপবিত্র করা ইত্যাদি। শায়খাইন (র)-এর মতে, এটা হারাম ও হালাল কোনটিরই অন্তর্ভূক্ত নয়। তবে হারামের নিকটবর্তী।

   মাকরূহে তানযিহীঃ- যা গ্রহন করা অপেক্ষা বর্জন করা শ্রেয়। যে কাজ হালালের নিকটবর্তী তবে হালাল নয়। যথা- দাঁড়িয়ে পানি পান করা,পশুর গলায় ঘন্টা বেধে দেয়া ইত্যাদি।

    ইসলামী আইনের বিষয়সমুহঃ- ইসলাম হলো মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ শান্তিময় জীবন ব্যবস্থা। তাই তার আইন-কানুন মানব জীবনের সকল বিভাগে পরিব্যপ্ত। নিম্নে তার বিষয়গুলোর আলোচনা পেশ করা হল-

    ১। আকাঈদঃ- আকাঈদ মানে হল বিশ্বাস করা। আল্লাহর প্রতি ঈমান, ফেরেশতাদের, আসমানি কিতাব, নবী-রাসূলদের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, তাকদীরের প্রতি ঈমান আনার নাম হল আকাঈদ।

    ২। শিষ্টাচারঃ- আল্লাহর হক, রাসূল (স) এর হক, দীনের পথে চলার সর্বাত্নক চেষ্টা সাধনা, বান্দার হক, পিতা মাতার, সন্তানের, প্রতিবেশির হক। বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ করা ইত্যাদি হল শিষ্টাচার।

   ৩। আখলাক ও চারিত্রিক বিষয়ঃ- উত্তম চরিত্রের উপকরণসমূহ যেমন- ধৈর্য ধারণ, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা, অপরকে অগ্রাধিকার দেয়া, ইনসাফ করা, সততা, লজ্জাবোধ, বিনয়ী হওয়া, গর্ব অহংকার পরিত্যাগ করা, খারাপ চরিত্রের উপকরন সমূহ যেমন- যুলুম-অত্যাচার, হিংসা, প্রতারণা, অলসতা ইত্যাদি।

   ৪। ব্যক্তিগত ইবাদতঃ- ব্যক্তিগত ইবাদত সমুহ হলো- পবিত্রতা ও তার মর্যাদা, আভ্যন্তরীন পবিত্রতা। অযু-গোসলের হুকুম সমূহ, নামাজের প্রয়োজনীয় বিষয়সমুহ, রোযা, হজ্জ, যাকাত ও কোরবানীর প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও হুকুমসমূহ সম্পর্কে বিস্তারীত জ্ঞাণ লাভ করা।

   ৫। পারস্পরিক আচরণের হুকুমসমূহঃ- জিহাদ ও তার হুকুম এবং নিয়মাবলী, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত নিয়মাবলী, সুদের নিয়মাবলী, দাম্পত্য জীবন, তালাক, হিলা, বিবাহ, ওয়াকফ, হেবা, ওয়ারিশ, কসম, কাফফারা, জবাই, শিকার, পানীয় গ্রহন, বিচার ব্যবস্থা, যাদুকর, মুরতাদ, সন্ত্রাসী, বিচার ব্যবস্থা, ক্রীতদাস, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়াবলীর বিস্তারিত নিয়মাবলী ও মাসয়ালাসমূহ আহকামুশ শরীয়ার অন্তর্ভূক্ত।

    ফিকহ শাস্ত্রের কতিপয় পরিভাষাঃ-

   ১। মুতাকাদ্দিমীনঃ- ইমাম আবু হানিফা ও সাহেবাইন (র)-এর সমসাময়িক ফকীহগণ। কারো মতে, ইমাম মুহাম্মদ (র) পর্যন্ত ফকীহগণ।

   ২। মুতাআখ্যিরীনঃ- মুতাকাদ্দিমীনের পরবর্তী ফকীহগণ। কারো মতে মুহাম্মদ (র)-এর পর হতে হাফিযুদ্দিন বুখারী (র) পর্যন্ত সকল ফকীহ।

আল্লামা যাহবী (র) হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর পূর্বের ফকীহগণকে মুতাকাদ্দিমীন ও পরবর্তীগণকে মুতাআখ্যিরীন হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।

   ৩। আইম্মায়ে আরবাআঃ- মাযহাব চতুষ্টয়ের প্রবর্তকগণ। যা ইমাম আবূ হানীফা, শাফেয়ী, মালেক, আহমদ ইবনে হাম্বল (র)।

   ৪। আইম্মায়ে ছালাছাঃ- ইমাম আবূহ হানিফা (র), ইমাম আবূ ইউসুফ (র) ও ইমাম মুহাম্মদ (র)।

   ৫। শায়খাইনঃ- ইমাম আবূ হানিফা (র) ও ইমাম আবূ ইউসুফ (র)। তারা দু'জন ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর শিক্ষক ছিলেন।

   ৬। সাহেবাইনঃ- ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র) উভয়ে ইমাম আবু হানিফা (র)-এর ছাত্র ছিলেন। ( এ হসেবে উভয়ে পরস্পর সাথী)

   ৭। তরফাইনঃ- ইমাম আবূ হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র)। (শিক্ষক-ছাত্র হওয়ায় দু'দিকের দু'জন হলেন তরফাইন)।

   ৮। সলফ ও খলফঃ- আবূ হানিফা (র) হতে ইমাম মুহাম্মদ (র) পর্যন্ত ফকীহগণ সলফ এবং তৎপরবর্তী হতে ইমাম শামসুল আইম্মা ও হালওয়ায়ী পর্যন্ত ফকীহগণ খলফ।

   ৯। রিওয়াইয়াতুয যাহিরঃ- ইমাম মুহাম্মদ (র) লিখিত ছ'টি গ্রন্থের কোন একটির বর্ণনা। গ্রন্থ ছ'টি হলো- জামে সগীর, জামে কবীর, সিয়ারে সগীর, সিয়ারে কবীর, মাবসূত ও যিয়াদাত।

  ১০। কুতুবুন্নাওয়াদিরঃ- উপরোক্ত ছ'টি গ্রন্থ ছাড়া ইমাম মুহাম্মদ (র) রচিত অন্যান্য কিতাব সমূহ।

  ১১। সদরুল আউয়্যালঃ- প্রথম তিন যুগ তথা সাহাবায়ে কিরাম (র), তাবেয়ীন ও তাবেঈ তাবেয়ীনের যুগের ব্যক্তিবর্গ।

   যুগে যুগে ইলমে ফিকহ বা এর ইতিহাসঃ-

   ইসলামের স্বর্ণযুগে নবী করীম (স) এর সাহাবীগণের মধ্যে দু'রকমের সাহাবী ছিলেন। এক- যারা হাদীস হেফয ও রেওয়ায়েতের কাজে সর্বক্ষণ নিয়োজিত থাকতেন। যেমন- হযরত আবু হুরায়রা, আনাস ইবনে মালেক (রা) প্রমুখ। দুই- যারা কুরআন, হাদীস গবেষনা করে শাখাগত মাসায়েলের সুষ্ঠু সমাধান বের করার কাজে বেসি মনোযোগী থাকতেন। যেমন- হযরত আলী, ইবনে আব্বাস, ইবনে মাসুদ (রা) প্রমূখ।

    প্রাথমিক যুগঃ- মহা নবী (স)-এর জীবদ্দশায় কোন সমস্যা দেখা দিলে তা নবী (স) নিজেই ওহীর মাধ্যমে সমাধান করতেন। নবী (স)-এর ওফাতের পর সমসাময়িক সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য আল-কোরআনের ও হাদীসের ব্যখ্যার প্রয়োজন হয়। আর সে সকল সমস্যার সমাধান কল্পে ফিকাহ শাস্ত্রের উৎপত্তি হয়।

    সাহাবীদের যুগঃ- ইসলামী শরী'আর বিধান সংক্রান্ত নতুন পরিস্থিতির মোকাবেলায় সাহাবাগণ প্রথমে তার সমাধান পবিত্র আল-কোরআনে খোজ করতেন, তাতে উক্ত সমস্যার সমাধান না পেলে সুন্নাতে রাসুল (স)-এর সুন্নাহ মুতাবিক সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মীমাংসা করতেন। যদি উক্ত দু'টি পদ্দতিতে সমাধান না পাওয়া যেত তবে তারা এই বিষয়ে ইজতিহাদ করতেন। হযরত ওমর (রা) সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করতেন, এবং প্রয়োজনে বিতর্ক সভাও করতেন। হযরত উসমান (রা) নিজেই ইজতিহাদ করতেন। আর এই মহান সাহাবীগণের যুগে আরও কিছু ফকীহ সাহাবী পবিত্র কুরআন, সুন্নাহ ও ইজতিহাদের দ্বারা ইসলামী শর'য়ী বিধান বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসলামী আইনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। এ যুগে যারা প্রসিদ্ব ছিলেন হযরত উমর, উসমান,আলী, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আয়িশা, ইবনুল আব্বাস, যায়িদ বিন সাবিত (রা) প্রমূখ সাহাবীগণ।

    তাবে'ঈদের যুগঃ- সাহাবাদের যুগ হিজরী ১১০ সাল নাগাদ শেষ হওয়ার পর থেকে তাবে'ঈগণের যুগ শুরু হয়। মহান সাহাবীদের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত  সকল তাবে'ঈগণের ইজতিহাদ প্রায় একই পদ্বতি ও ধারায় পরিচালিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রসিদ্ব হলেন-হযরত নাফে (র), হযরত ইকরামা (র), হযরত আতা ইবনে রাবাহ (র), হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (র), হযরত হাসান আলবসরী (র), সালিম (র) যুহরী (র) প্রমূখ।

    ফুকাহায়ে সাবয়াঃ- তাবে'ঈনের যুগে প্রসিদ্ব সাতজন ফকীহ ছিলেন। ইমাম ইবনে মোবারক রেওয়ায়েত করেন-যখন কোন গুরত্বপূর্ণ মাসয়ালা পেশ হতো এ সাতজন উক্ত ব্যপারে চিন্তা-গবেষনা করতেন। তারা সুষ্ঠু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কাযী সে বিষয়ে কোন মতামত দিতেন না। তারা হলেন ক। সাঈদ ইবনে মুসায়্যেব (র) মৃত্যু ৯৪ হিজরী, খ। উরওয়া ইবনে যুবাইর ইবনে আওয়াম (র) মৃত্যু ৯৪ হিঃ, গ। কাসেম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর (র) মৃত্যু ১০৮ হিঃ, ঘ। খারেজা ইবনে যায়েদ ইবনে সাবেত (র) মৃত্যু ৯৯ হিঃ, ঙ। উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ উতবা ইবনে মাসউদ (র) মৃত্যু ৯৮ হিঃ, চ। সুলায়মান ইবনে ইয়াসার (র) মৃত্যু ১০৯ হিঃ, ছ। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (র) অথবা মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ হলবী (র) মৃত্যু ৬১৪ হিঃ।

   হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর তৃতীয় দশক হতে ইলমে ফিকহ রচনার কাজ নিয়মিতভাবে সূচিত হয়, সে সময় হতে বর্তমান পর্যন্ত ইলমে ফিকফের ক্রমবিকাশকে মোটামুটিভাবে তিন স্তরে বিভক্ত করা যায়।

     প্রথম স্তরঃ গবেষণা ও সংকলণের যুগঃ- এযুগে ইমাম আবূ হানিফা (র) নিয়মিতভাবে ফিকহ শাস্ত্র রচনার কাজ শুরু করেন এবং তার জীবদ্দশায় এ কাজ সম্পন্ন করেন। এ জন্য ইমাম আবু হানিফাকে ইলমে ফিকাহর স্থপতি বলা হয়। এ কাজের জন্য তিনি একহাজার ছাত্র থেকে মাত্র চল্লিশ জনের একটি মজলিশে শুরা গঠন করেন। এ সময় উসূলে ফিকাহ নামক একটি বিদ্যা ও রচিত হয়। অতএব ফিকহ ও উসূলে ফিকহ উভয় শাস্ত্রই  এ যুগে সূচিত হয়। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর তৃতীয় দশক হতে তৃতীয় শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সময়কে ফিকহ সংকলণের প্রথম স্তর হিসাবে গণ্য করা হয়।

    দ্বিতীয় স্তরঃ পূর্ণতা ও অনুকরণের যুগঃ- এ যুগটি চতুর্থ শতাব্দীর শুরু হতে সপ্তম শতাব্দী আব্বাসীয় খেলাফতের ফতন পর্যন্ত। এ যুগেই সাধারণত তাকলীদ বা মাযহাব অনুকরণের প্রচলন হয়। সাধারণ মানুষ ও আলেমগণও কোন  না মাযহাবের অনুসরণ করতেন। ইজতিহাদের ধারা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আর পরিশেষে চার মাযহাব এর ওপর সীমিত হয়ে যায় এবং এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমাও প্রতিষ্ঠিত হয়।

    তৃতীয় স্তরঃ তাকলীদের যুগঃ- হিজরী সপ্তম শতাব্দীর মধ্য ভাগ তথা আব্বাসীয় শাসণের অবসানের পর হতে এ স্তর সুচিত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের ইমাম-মুজতাহিদ ও তাদের অনুসারী বিখ্যাত উলামায়ে কিরাম এমন ভাবে মাসয়ালা নির্ণয় করেন যে, এখন আর ইজতিহাদের প্রয়োজন পরে না। উল্লেখ্য যে, এ স্তরেও বহু ফিকহী গ্রন্থ রচিত হয়। তবে সেগুলো প্রথম ও দ্বিতীয় যুগে রচিত গ্রন্থের টীকা, ব্যাখ্যা মাত্র। এক একটি বিষয়ে তিন দিন পর্যন্ত আলোচনা-পর্যালোচনা চলতো। অতঃপর গৃহীত মতটি লিপিবদ্ব করা হত। এবং এতে আফিয়া ইবনে ইয়াজিত (র) সহ সকলে ঐক্যমতে পৌছলে একে "মুত্তাফাকুন আলাইহি" হিসেবে গৃহিত হত, নতুবা "মুত্তাফাকুন ফিহ" রূপে তাদের নাম লিপিবদ্ব করা হত। এ পদ্ধতিতে ইমাম মালেক (র)-এর বর্ননা মতে ষাট হাজার এবং আবু বকর ইবনে আতীক (র)-এর ভাষ্যমতে পাচ লক্ষ মাসায়েলের সুষ্ঠু সমাধান প্রদান করেন।

শরী'আত নির্দেশিত দিক নির্দেশনায় পদ্বতিগত কিছু পার্থক্যের কারণে ইসলামে প্রধানত চারটি মাযহাবের উৎপত্তি হয়। নিন্মে এই চার মাযহাবের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো-

     ১। হানাফী মাযহাবঃ- মাযহাবসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ মাযহাব হলো হানাফী মাযহাব। পৃথিবীর অধিক সংখ্যক মুসলমান এ মাযহাবের অনুসারী। ইমাম আবু হানিফা (র)-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৭০০ সালে কুফায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইসলামী শরী'আতের বিভিন্ন উৎসের উপর গবেষণা করে 'ফিকহুল আকবর' নামে একটি আইন শাস্ত্র প্রণয়ন করেন। তিনি আল-কোরআনের আলোকে যুক্তির সাহায্যে যে কোন প্রশ্নের মীমাংসা করার চেষ্টা করতেন। তাই তাকে ও তার সহচরদেরকে "যুক্তিবাদী" বলা হত। তাকে বাগদাদে সমাহিত করা হয়।

    ২। মালিকী মাযহাবঃ- এই মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইমাম মালিক (র)। তিনি ৭১৩ সালে মদীনায় জন্ম গ্রহন করেন। ইসলামী আইন প্রণয়নে তিনি কুরআন ও হাদীসের উপর বেশি গুরুত্ব দিতেন। যুক্তিকে তিনি তেমন কোন প্রাধান্য দেননি। তিনি বহু সংখ্যক হাদীস মুখস্থ করেছিলেন। "কিতাবুল মুয়াত্তা" তারই রচিত গ্রন্থ। তার নামানুসারে এই মাযহাবের নাম করা হয় মালিকি মাযহাব।

    ৩। শাফে'ঈ মাযহাবঃ- এই মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইমাম শাফেয়ী (র)। তিনি ৭৬৭ সালে ফিলিস্তিনে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি প্রথমে ইমাম মালিকের একজন প্রিয় শিষ্য ছিলেন এবং হানাফী মাযহাব সম্পর্কে জ্ঞাণার্জন করেন। তার রচিত গ্রন্থের নাম "কিতাবুল উম্ম"। ইসলামী আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তিনি হাদীসকেই মূলভিত্তি হিসেবে অবলম্বন করেন। তার প্রতিষ্ঠিত শাফে'ঈ মাযহাব হানাফী ও মালিকী মাযহাবের মাঝামাঝি পন্থা। হানাফী মাযহাব শুধু কুরআনকেই এবং মালিকী মাযহাব শুধু মদীনার প্রচলিত হাদীসকেই গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু ইমাম শা'ফেঈ সকল হাদীসের উপর সমানভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। মদীনার হোক বা অন্যান্য দেশের রাবীর বর্ণনাই হোক সকল হাদীসকেই তিনি গ্রহন করেছেন।

   ৪। হাম্বলী মাযহাবঃ- এই মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল। তিনি ৭৮০ সালে বাগদাদে জন্মগ্রহন করেন। তিনি প্রথমে ইমাম শাফে'ঈর একজন ভক্ত ও শিষ্য ছিলেন। তিনি হাদীসের উপর গবেষনা করে ইসলামী আইন শাস্ত্রের জ্ঞাণ অর্জন করেন। তার রচিত গ্রন্থের নাম "মুসনাদে আহমদ"। তার মাযহাবের প্রধান ভিত্তি হাদীস। তিনি কোন প্রকার যুক্তিতর্ক পছন্দ করতেন না। তার মতবাদ তদানীন্তন মুসলাম সমাজকে শিরক ও বিদ'আত থেকে রক্ষা করেছিল। তার মতবাদ যুক্তিবাদী মু'তাযিলাদের মতবাদের তীব্র বিরোধী ছিল। এ কারণে তার মাযহাবকে ইসলামের মূলনীতির দুর্গ বলা হয়।

   ফকীহগণের স্তরসমূহঃ- ফিকহ শাস্ত্রবিদগণ সাত স্তরে বিন্যস্ত। যথা-

  ১। প্রথম স্তরঃ- ইজতিহাদের পূর্ণাঙ্গ শর্তাবলীর অধিকারী ফকীহগণ। যথা- ১। ইমাম আযম আবু হানিফা (র), ২। ইমাম শাফেয়ী (র), ৩। ইমাম মালেক (র), ৪। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র), ৫। ইমাম আওযায়ী (র), ৬। ইমাম সুফিয়ান সাওরী (র), ৭। ইমাম দাউদ যাহেরী (র) ও ৮। ইম্মাম তাবারী (র)।

   ২। দ্বিতীয় স্তরঃ- মাযহাবের স্বীকৃত উসূলের ভিত্তিতে ইজতিহাদকারী ফকীহগণ। যথা- ১। ইমাম ইউসূফ (র), ২। ইমাম মুহাম্মদ (র), ৩। ইমাম যুফার (র), ৪। ইবরাহীম নাখয়ী (র)। এসকল ব্যক্তি হানাফী উসূলের ভিত্তিতে কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস হতে মাসয়ালা সমাধান করতেন।

   ৩। তৃতীয় স্তরঃ- প্রথম স্তরের ইমামগণ দ্বারা গৃহীত নীতিমালার ওপর গবেষণাকারী ফকীহগণ। যে সকল বিষয়ে ইমামদের থেকে  কোন সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই সে বিষয়ে তারা ইজতিহাদ করতেন। মূলত তারা মাযহাব প্রবর্তক ইমামের সাথে ভিন্ন মত প্রকাশের অধিকারী নন। তারা হলেন- ১। ইমাম আবু বকর খসসাফ (র), ২। ইমাম তাহাবী (র), ৩। ইমাম কারখী (র), ৪। শামসুল আইম্মা হালওয়ায়ী (র), ৫। শামসুল আইম্মা সরখসী (র), ৬। ফখরুল ইসলাম বযদবী (র) ও ৭। কাযী খান (র)।

   ৪। চতুর্থ স্তরঃ- পূর্ববর্তী ইমামগণের ফতোয়ার দলীল চয়ন করার কাজে নিবেদিত প্রেণ ব্যক্তিবর্গ। তারা ইজতিহাদের ক্ষমতাসম্পন্ন নন। তবে ইজতিহাদের সকল নিয়ম-কানুন তাদের আয়ত্বে। যথা- ইমাম আবু বকর জাসসাস রাযী (র)।

   ৫। পঞ্চম স্তরঃ- দলীল-প্রমাণ ও যুক্তির আলোকে একই প্রসঙ্গে বিভিন্ন মতামতের মধ্যে একটিকে অপরটির উপর প্রাধান্যদানের অধিকারী ফকীহগণ। যথা- ১। আল্লামা বুরহান উদ্দীন আল মুরগিনানী (র), ২। আল্লামা আসবী জাবী (র), ৩। আল্লামা কুদূরী (র) এ স্তরের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। কারো  মতে তারা চতুর্থ স্তরের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন।

   ৬। ৬ষ্ঠ স্তরঃ- এ স্তরের ফকীহগণ উত্তম, মধ্যম, অধম, যাহের ও দূর্বল বর্ণনা সমূহের মাঝে পার্থক্য করতে পারতেন। যথা- ১। শামসুল আইম্মা কুদূরী, ২। জামালুদ্দীন হাসীরি (র) ও মুখতার, বেকায়া, মাজমা ইত্যাদি গ্রন্থকারগণ।

   ৭। সপ্তম স্তরঃ-মাযহাবের ফতোয়া পারদর্শী উলামায়ে কেরাম, যারা উপরিউক্ত কোন প্রকার দক্ষতার অধিকারী নন। এ স্তরটি মূলত তবকাতে ফুকাহার অন্তর্ভুক্ত নয়।

উপসংহারঃ- ইসলামের সাথে পাশ্চাত্য রচিত আইনের বহু ক্ষেত্রেই বিরোধ রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রীয় সভ্যতার পতনের সাথে সাথে মুসলিমদের সাহিত্য, বিজ্ঞান ও আইনের গবেষণায়ও চরম স্থবিরতা নেমে আসে। ফলে মুসলিম ফকীহগণের আইনের গবেষণা ব্যক্তিগত ইবাদত বন্দেগী, বিবাহ-তালাক ইত্যাদির মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে। তবে আশার বিষয় এই যে, সম্প্রতি ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক কিছু প্রতিষ্ঠান ইসলামী আইনের কাঠামোতে পরিচালনা ও বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু হয়েছে। বর্তমানে ব্যাপক ভিত্তিতে ইজতিহাদ ও গবেষণার মাধ্যমে ইসলামী আইনশাস্ত্র পূর্ণাঙ্গভাবে প্রণয়নের চেষ্টা অব্যাহত রাখা অতীব জরুরী। তা না হলে বর্তমান প্রজন্মকে ইসলামী আইন সম্পর্কে পরিচালনা করা মোটেও সম্ভব নয়। এ জন্য সচেতন ব্যক্তিবর্গকে এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে।

 

NUR HUSAIN

ANNUR.IT

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: