মহিমান্বিত মিরাজ রজনীর ঘটনাবলী

মিরাজ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিস্ময়কর মুজিজা। নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ (সাঃ) এর সত্য রাসূল হওয়ার জন্য একটি বড় নিদর্শন। মিরাজ হযরতের শ্রেষ্ঠত্বের এক অকাট্য দলীল। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে রজনীর কিয়দংশে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চতুস্পার্শ্ব আমি বরকতময় করেছি, তাঁকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা (সূরাঃ বনি ইসরাঈল, আয়াত- ১)।

 

মিরাজ শব্দটি উরূজ শব্দমূলের রুপান্তর, যার অর্থ উর্দ্ধগমন। পবিত্র মক্কা মুকাররমা থেকে রাতের একটা ক্ষুদ্র অংশে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত তাশরীফ নেয়াকে বলা হয় ইসরা, বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আসমান সমুহ ভ্রমণ ও বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাকে বলা হয় মিরাজ । নবুওতের একাদশ কিংবা দ্বাদশ বর্ষে ২৭ শে রজব সোমবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে মিরাজের মত নেয়ামত লাভ করেন। ঐ দিন গভীর রজনীতে পৃথিবীর রক্ত মাংশের এক পবিত্র আত্মাধারী মানুষ মহান আল্লাহ পাকের আহবানে উর্দ্ধে গমণ করে তাঁর একান্ত সান্নিদ্ধে গিয়ে পৌঁছেছিলেন।

মিরাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনাঃ-

মহানবী রজবের ২৭ তারিখ রাতের শেষার্ধে তাঁর দুধ বোন উম্মে হানী বিনতে আবি তালিব এর গৃহে (বর্তমানে কাবা সংলগ্ন হাতিম) বিশ্রাম করছিলেন। এমনি সময় আল্লাহর হুকুমে হযরত জিবরাইল (আঃ) একদল ফিরিশতা ও বোরাক নিয়ে মহানবী (সাঃ) এর নিকট আসলেন। তাঁকে জাগিয়ে তুললেন এবং তাঁর বক্ষ বিদারণ (সীনাচাক) করে জমজম কুপের পানি দ্বারা তা ধৌত করলেন এবং রহমত, বরকত ও নূরে এলাহী দ্বারা বক্ষ মোবারক পরিপূর্ণ ও মহিমান্বিত করলেন। হাউজে কাওসারের পানি দ্বারা গোসল দিলেন, জান্নাতি পোশাকে প্রিয় নবীজীকে সুসজ্জিত করলেন। এরপর আল্লাহ পাকের আমন্ত্রনের কথা জানালেন। আল্লাহর আমন্ত্রনের কথা জানতে পেরে প্রিয় মিলণের স্বতঃস্ফুর্ত চিত্তে তিনি বোরাকে আরোহন করেন।

উল্লেখ্য যে, বোরাক একটি বৈদ্যুতিক যান । বোরাক শব্দের আভিধানিক অর্থ বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের গতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ছিয়াশী হাজার মাইল। বোরাকের গতি ছিল তার চেয়েও বেশী। বোরাক অতিশিঘ্র বায়তুল মুকাদ্দাসে উপনীত হয়। বায়তুল মুকাদ্দাসে আল্লাহর প্রেরীত পূর্ববতী অসংখ্য নবী-রাসূল ও ফেরেশতা প্রিয় রাসূলকে অভিবাদন ও সম্ভাষণ জানানোর জন্য অপেক্ষমান ছিলেন। লাখ লাখ নবী-রাসূল ও ফেরেশতা ইমামুল আম্বিয়ার পেছনে নামাজ আদায় করে মুক্তাদি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করলেন।

ইবনে কাইয়েম লিখেছেন-সঠিক বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায় যে, নবী সাইয়েদুল মুরসালিনকে স্বশরীরে বোরাকে তুলে হযরত জিবরাইল (আঃ) এর সঙ্গে মসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। মসজিদের দরজার খুঁটির সাথে বোরাক বেধে রাখেন। এরপর প্রিয়নবী সেখানে যাত্রা বিরতী করেন এবং সকল নবীর ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করেন।

নামাজ সমাপনান্তে উর্দ্ধ জগতের ভ্রমণ প্রস্তুতি শুরু হল। দ্রুতগতি সম্পন্ন বোরাক মুহুর্তেই প্রথম আসমানে পেঁৗঁছল। আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) তাঁর সন্তান হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে অভিনন্দন জানান। দ্বিতীয় আসমানে হযরত ইয়াহিয়া (আঃ), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আঃ), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আঃ), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আঃ), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আঃ) এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ করেন।

প্রত্যেক আসমানে দ্বাররক্ষী ফেরেশতাগণ যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন পূর্বক সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে তাঁর আগমন বার্তা অন্যান্য অগনিত ফেরেশতাদের মাঝে প্রচার করে দিলে তারা মহাউল্লাসে মারহাবা ধ্বনীতে চারিদিক মুখরিত করে তুলে। তিনি প্রতি আসমানেই একটি করে হিরা মুক্তা খঁচিত বেহেশতি পোশাক উপহার পান। প্রত্যেক পোশাকেই কোরআন শরীফের একটি করে আয়াত স্বর্নাক্ষরে লিখিত ছিল। তন্মধ্যে ষষ্ঠ আসমানের পোশাকটিতে লিখা ছিল-হে লোক সমাজ! তোমাদের নিকট এমন এক পয়গম্বর আগমন করেছেন যিনি তোমাদেরই স্বজাতি থেকে, যার নিকট তোমাদের ক্ষতিকর বিষয় অতীব দুর্বিসহ হয়। যিনি তোমাদের অতিশয় হিতৈষী। আর (বিশেষ করে) মুমিনদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহশীল, করুনা পরায়ন (সূরাঃ তওবা, আয়াত- ১২৮)।

সপ্ত আসমান থেকে মহানবী (সাঃ) ক্রমশ উর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পানে উন্নীত হন। এটি ছিল একটি স্পেস ষ্টেশন, যেখানে রাসূলে আকরাম (সাঃ) বাহন বদল করেন এবং নতুন আরেকটি যানে আরোহন করেন। কোরআন পাকে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- তিনি সিদরাতুল মুন্তাহা নামক অপূর্ব সৌন্দর্যময় একটি বৃক্ষ দেখেছিলেন। যার অনতিদূরেই জান্নাতুল মাওয়া নামক বেহেশত অবস্থিত। আল্লাহ পাকের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনাবলীর কিয়দংশ তিনি পরিদর্শন করেছিলেন। এই সকল নিদর্শন দেখায় তাঁর চক্ষু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় নি কিংবা তিনি লক্ষ্যকে অতিক্রম করেন নি (সূরাঃ নজম, আয়াত-১৮৭)।

মক্কা থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত হযরত জিবরাইল (আঃ) সাথে ছিলেন। তারপর অপর একজন জ্যোতির্ময় ফেরেশতা একটি স্বর্ণের বেহেশতি তখতের উপর রাসূলুল্লাহকে উপবিষ্ট করে প্রথম মনযিলে উপনীত হন। ক্রমান্বয়ে তিনি ২য়, ৩য় করে একেবারে ৫ম মনযিল এ চলে যান। ২য় মনযিলে হযরত আযরাইল (আঃ) ও ৪র্থ মনযিলে হযরত ইস্রাফিল (আঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। হযরত ইস্রাফিল (আঃ) এর সাথে সাক্ষ্যাৎ করে অল্প সময়ের মধ্যে বহুসংখ্যক নূরের পর্দা অতিক্রম করে এমন একটি জায়গায় উপস্থিত হলেন যেখানে তাঁকে রফরফ নামক একটি দ্রুতগতি সম্পন্ন বাহন দেওয়া হয়।

রফরফ অর্থ চলন্ত সিড়ি (Acsalator)z উহা ছিল গদি বিশিষ্ট আসনওয়ালা। যার গতি ছিল আলোর গতি অপেক্ষা লক্ষ লক্ষ গুণ বেশী। অতঃপর রফরফে উপবেশন করে তিনি সত্তর হাজার নূরের পর্দা পার হয়ে আরশে আযীমের দিকে রওয়ানা হলেন । ঐ সময় তিনি হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এর কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন-আপনি এখন আরশে আযীমে পৌঁছে গেছেন। মস্তক অবনত করুন, আল্লাহর সঙ্গে কথা বলুন। তার আদেশ নিষেধ শ্রবণ করুন। অতঃপর মুহাম্মদ (সাঃ) নম্রতা ও ভীতির সাথে পরম করুণাময় আল্লাহর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। তারপর মহান আরশে আযীমে একটা গভীর পর্দার অন্তরালে হাবীবে এলাহীর সাথে বাক্য বিনিময় হয়।

হুজুর (সাঃ) আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে আত্তাহিয়্যাতো লিল্লাহে পড়ে আল্লাহর শুররিয়া আদায় করেন। মহান আল্লাহ খুশী হয়ে তাঁর হাবীবকে সালাম দেন। সালাম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ফেরেশতারা কালেমা শাহাদৎ পড়ে সাক্ষী দেয় যে, আল্লাহ এক ও মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর রাসূল তারপর আল্লাহ স্বয়ং ও ফেরেশতারা মহান নবীর উপর দরূদ পাঠ করেন।

আল্লাহর সাথে সালাম-কালাম, আলাপ-আলোচনার পর ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন এবং বলেন- এই ৫ ওয়াক্ত আপনার উম্মতের জন্য মিরাজ। তারা নামাজের মধ্যে আমার সঙ্গে কথা বলবে। হাদীসে এসেছে- নামাজ মুমীনের জন্য মিরাজ (মিশকাত শরীফ)। ফেরার পথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তিনি তাঁর উম্মতের নামাজ, রোজা সহ বিভিন্ন হুকুম, আহকাম নিয়ে আসেন।

কালামে পাকে এসেছে-তিনি আরশের সর্বোচ্চ স্থানে পেীঁছলেন। অতঃপর নিকটবর্তী হয়ে ঝুলে গেলেন। ধনুকের দুই মাথার ব্যবধান ছিল। অথবা আরও কম। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা প্রত্যাদেশ করলেন। তিনি মিথ্যা বলেননি। তিনি যা দেখেছেন, তোমরা কি তাঁর দেখা বিষয় নিয়ে বিতর্ক করছ? (৫ঃ ৭-১২)

বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আরশে আযীম পর্যন্ত ভ্রমণকালে তিনি আসমান, জমীন, আলমে বরযখ, আরশ, কুরসি, লওহ, কলম বেহেশত, দোযখ সহ অদৃশ্য সৃষ্টিরাজী অবলোকন করেন। হুজুর (সাঃ) জান্নাতুল ফেরদাউসে ভ্রমন করেন। উক্ত জান্নতের চারটি দরজা। তার একটি দরজায় স্বর্নাক্ষরে লিখা আছে-যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অপরের উপকারার্থে করযে হাসানা প্রদান করে, আল্লাহ তার মালের মধ্যে বহুগুণে বরকত বাড়িয়ে দেন। বেহেশতের মাটি সমূহ বিশুদ্ধ মেশক্‌ আম্বরের। প্রত্যেক বেহেশতের নিম্ন দিয়ে নানা রকমের নদী প্রবাহিত হচ্ছে। কোন নদীর পানি দুগ্ধের মত, কোনটার পানি পবিত্র শরাব এবং কোনটার পানি স্বচ্ছ মধুর মত। বেহেশত প্রদর্শনের পর তিনি দোযখের অগ্নির প্রখরতা দর্শন করে পৃথিবীর পথে প্রত্যাবর্তন করেন।

মিরাজ জাগ্রতাবস্থায় শরীর ও রুহ মোবারক উভয়টি সহকারে সংঘটিত হয়েছে। এটিই অধিকাংশ মুসলমানের আকিদা বা দৃঢ় বিশ্বাস। আয়াতে বর্ণিত বেআবদিহি শব্দ দ্বারা এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারণ শুধুমাত্র আত্মাকে আবদ বা বান্দা বলে না। বরং আত্মা ও দেহের উভয়ের সমষ্টিকে আবদ বা বান্দা বলে। বস্তুত মেরাজ রুহানী, স্বাপ্নিক বা আত্মিক ছিলনা বরাং তা শারীরিক ছিল। সূরা বনি ইসরাঈলে আল্লাহ পাক মিরাজের ঘটনাকে মানবজাতির জন্য একটা পরীক্ষা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ কেউ এ ঘটনাকে বিশ্বাস করে, কেউ অবিশ্বাস করে, কেউ বলে মিরাজ স্বপ্নে হযেছিল, কেউ বলে স্বশরীরে হয়েছিল। তবে হুজুরের বিরাট সাহাবীর দল এবং আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা হলো এই উর্দ্ধারোহণ হুজুর পাক (সাঃ) স্বশরীরে করেছিলেন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরতার এ সন্ধিক্ষণে মিরাজুন্নবী কে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মিরাজ রজনীতে আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবীবকে অসাধারণ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দানে ধন্য করেছেন। মিরাজুন্নবী প্রিয় রাসূলের সমুন্নত মর্যাদার প্রকৃত প্রমাণ। মিরাজ রজনীতে রাসূল (সাঃ) নামাজ, রোজা সহ যে সকল হুকুম আহকাম নিয়ে আসেন সেগুলো পালনের মাধ্যমে ইহকাল ও পরকালে সফলতা লাভ করা যাবে।

তথ্য সুত্রঃ

১। মাসিক মদীনা; জানুয়ারী-১৯৯৪

২। মাসিক মদীনা; জুলাই-১৯৯৬

৩। মাসিক মদীনা; এপ্রিল-২০০১

৪। মাসিক আর-রশীদ; রজব-১৪১৪ হিঃ

৫। দৈনিক ইনকিলাব; ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০২

৬। ইসলামী বিশ্বকোষ; ৫ম খন্ড।

৭। ইসলামী চিন্তাধারা; শামসুল আলম

৮। কাসাসুল আম্বিয়া; মাওলানা আবু নাইম

৯। আর রাহিকুল মাখতুম; মাওলানা সফিউর রহমান মোবারকপুরী

১০। সাপ্তাহিক আরাফাত; ১৬ অক্টোবর-২০০০

১১। মাসিক আত-তাহরিক; নভেম্বর-১৯৯৯

১২। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পবিত্র মেরাজ; আলহাজ্জ মোঃ আব্দুর রহিম মিঞা

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: