লাইলাতুল ক্বদর উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এক মহা নিয়ামত

মানুষের প্রতি আল্লাহর যত করুনা ও অনুগ্রহ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত ও অনুগ্রহ হলো বান্দার জন্যে এমন একটি মহান রাতকে নির্দিষ্ট করা, যে একটি রাতেই তিনি বান্দাকে হাজার মাসে যতটুকু সওয়াব দিবেন তার চেয়ে বেশী সওয়াব দিবেন। সেই রাতটি হলো লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর ।

রমজান নামক যে সম্মানিত মেহমান আমাদের নিকট এসেছে তা শুধু শুধু আসেনি বরং নিয়ে এসেছে সর্বশ্রেষ্ট উপহার কদরের রাত্রি। যে রাত্রি অতি পবিত্র ও বরকতময়। এই রাত্রিতেই নাযিল হয়েছে সারা বিশ্ব জাহানের মানবের পথ প্রদর্শক, জীবন বিধান আল-কোরআন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে সূরা কদরে ঘোষণা করেছেন- আমি পবিত্র কোরআন ক্বদর তথা মর্যাদাবান রাতে নাযিল করেছি। আপনি কি জানেন কদর রাত্রি কি? ক্বদর রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে অবতীর্ণ হয় ফেরেশতাগণ ও রূহ, প্রতিটি কাজই তাদের প্রতিপালকের হুকুম মোতাবেক সম্পাদিত হয়। ফজর পর্যন্ত সব কিছু থাকে শান্তিময়।

ক্বদরের রাতের মর্যাদা ও মর্তবা মানুষের ধারণাতীত। উল্লেখিত সূরায় ক্বদরের রাত্রিকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলা হয়েছে। অর্থাৎ এই রাত্রিটি ৮৩ বছর ৪ মাসের সমান মর্যাদাবান। এই রাত্রিতে জাগরণ করে ইবাদত করলে ৮৩ বছরের চেয়েও বেশী সওয়াব পাওয়া যাবে। এমনি ভাবে হাজার মাস ৩০,০০০ দিনের সমান। সুতরাং এই দিনে যদি কেউ ১টি টাকা দান করে তাহালে সে ৩০,০০০ হাজার টাকার সমান সওয়াব পাবে।

হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, একবার রমযান মাসের আগমনে রাসূল (সাঃ) বললেন, দেখ! এ মাসটি তোমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। এতে এমন একটি রাত আছে, যেটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যাণ হতে বঞ্চিত হল সে যাবতীয় কল্যাণ হতেই বঞ্চিত হল। আর চির বঞ্চিত ব্যক্তিই কেবল এর সুফল হতে বঞ্চিত হয়। (ইবনে মাজাহ)

কোরআন হাদীস ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি যে, অন্যান্য নবী ও তাঁদের উম্মতদের হায়াত ছিল পাঁচশ, হাজার কিংবা তারও বেশী। তারা দীর্ঘ এই জীবনে অনেক ইবাদত বন্দেগী করার সুযোগ পায়। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মতদের হায়াত ৫০ থেকে ১০০ বছর কিংবা তার কিছু বেশী। ইবাদতের জন্য পূর্ববতীদের তুলনায় খুব অল্প সময়। কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদীর ইবাদতের সময় অল্প হলেও তাদের জীবনে আল্লাহ তায়লা এমন কতিপয় দিন বা রাত্রি নির্ধারণ করে দিয়েছেন যেসব দিন বা রাত্রিতে ইবাদত বন্দেগী করলে বহুগুণ বেশী সওয়াব পাওয়া যায়। যেমন- শবে মেরাজ, শবে বরাত, শবে কদর, দুই ঈদের রাত্রি, হজ্জের রাত্রি । এগুলি মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য খাছ নেয়ামত, যা অন্য কোন নবীর উম্মত পায়নি। রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেন- আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতকেই শবে কদর দান করেছেন এর পুর্বে কোন উম্মতকে তা দেয়া হয় নি। (দুররে মুনসুরঃ৮ম খন্ড, পৃঃ৫৮০)

ইবনে আবি হাতেম থেকে রেওয়ায়েত আছে রাসূল (সাঃ) একবার বনী ইরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকত এবং কখনও অস্ত্র সংবরণ করেনি। মুসলমানগণ শুনে বিস্মিত হলে সূরা ক্বদর অবতীর্ণ হয়। এতে এ উম্মতের জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সে মুজাহিদের এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ইবনে জারীর (রহঃ) অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বনী ইসরাঈলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যাক্তি সমস্ত রাত্রি ইবাদতে মশগুল থাকত ও সকাল হতেই জিহাদের জন্য বের হয়ে যেত এবং সারাদিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। সে এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ তায়ালা সূরা ক্বদর নাযিল করে এ উম্মতের শেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এ থেকে আরও প্রতিয়মান হয় যে, শবে ক্বদর উম্মতে মুহাম্মদীরই বৈশিষ্ট। (মাআরেফূল কোরাআন)

এ রাতে মানুষের প্রজ্ঞাপূর্ণ ফয়সালা নির্ণয় করা হয়। আল্লাহপাক আল-কোরআনে বলেন- এই রাতের সব ব্যাপারে প্রজ্ঞাপূর্ণ ফয়সালা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। (৪৪ঃ৪)। বুখারী শরীফের শরাহ উমদাতুল কারীতে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লাইলাতুল ক্বদর সম্পর্কে লিখেছেন- লাইলাতুল কদর বলতে এমন রাত্রি বুঝায় যাতে যাবতীয় বিষয়ের পরিমাপ করা হয়। এর চুড়ান্ত রুপদান করা হয় এবং একটি বছরের জন্য আল্লাহ তায়ালা এই রাতে সব বিধান ও মর্যাদা ফায়সালা করেন। ইমাম যুহুরী (রহঃ) বর্ণনা করেন-এ রাত অত্যান্ত মুল্যবান, অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন। শেখ আবু বকর ওয়াররাক বর্ননা করেন- এ মহান রাতে ইবাদতের কারণে এমন লোকের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি পায় ইতিপূর্বে যাদের মর্যাদা বা কদর ছিলনা। তাই এ রাতকে শবে ক্বদর বলা হয়।

রমজানের প্রথম দশকে রয়েছে বান্দার জন্য অগনিত রহমত ও অফুরন্ত নেয়ামত। মাঝের দশকে রোজাদারদের জন্য ক্ষমা লাভের সময় এবং শেষ দশকে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি লাভের সময়। এ মাসের ২০তম রজনীর পর যে কোন বেজোড় রাতে লুকিয়ে আছে মহামুল্যবান লাইলাতুল ক্বদর । হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- তোমরা লাইলাতুল ক্বদর রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত সমূহে অনুসন্ধান কর (বুখারী)। রাসূলে আকরাম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ক্বদরের রাত্রিকে জীবিত রাখবে, সে একশত বছরের সমপরিমান পূণ্য লাভ করবে। পরম কৌশলী আল্লাহপাক ক্বদরের রাত্রিকে লুকায়িত রেখেছেন, যেন আল্লাহর আশেক বান্দাগণ এ রজনীকে তালাশ করে এবং আল্লাহর মহব্বতের সাগরে নিজেকে বিসর্জন দেয়।

হাদীস শরীফে এসেছে নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন-অবশ্যই আল্লাহপাক পৃথিবীর রজনীসমূহকে লাইলাতুল ক্বদর দ্বারা সৌন্দর্যমন্ডিত করেছেন। এই রাত্রির ফযীলত ও মাহাত্ম এত বেশী যে, ইহার বদৌলতে সমুদয় রজনী মর্যাদার শীর্ষে সমাসীন হয়েছে। জীবনের যাবতীয় গুনাহ মাফের ইঙ্গিত দিয়ে মহানবী (সাঃ) বলেন- যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাস ও একীনের সাথে আল্লাহর বরকত লাভের আশায় এ রাতে ইবাদত বন্দেগী করে, করুণাময় আল্লাহপাক তার জীবনের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেন। সহীহ বুখারীর এক রেওয়ায়েতে রাসূল (সাঃ) বলেন-যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় ক্বদরের রাতে ইবাদত-বন্দেগী করে তার পূর্বের গোনাহ সমূহ মাফ করা হয়। রাসূল (সাঃ) আরও ইরশাদ করেছেন- হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা তোমাদের অন্ধকার কবরকে পূর্ণ রৌশনে ও আলোকজ্জল করতে চাইলে তোমরা শবে ক্বদরে ইবাদত বন্দেগী কর।

কদরের রাতে ইবাদত বন্দেগী করলে আল্লাহ পাক তার জন্য দোজখের আগুন হারাম করে দেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (সাঃ) বলেন- যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে ইবাদত বন্দেগী করবে, করুনাময় আল্লাহপাক তার উপর দোজখের আগুন হারাম করে দিবেন। হাদীস শরীফে আরও আছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, শবে ক্বদরে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) অগণিত ফেরেশতা সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে আগমণ করেন এবং প্রত্যেক ফেরেশতার হাতে সবুজ রংয়ের এক একটি করে বর্শা থাকে আর জিব্রাঈল (আঃ) মনোরম ছয়শত পাখার দ্বারা সুসজ্জিত থাকেন। তারপর মক্কা শরীফের কাজ্ঞবা গৃহের উপরে এসে তিনি ফিরিশতাগণকে চতুর্দিকে ভাগ করে দেন। উক্ত ফিরিশতাগণের কিয়দাংশ পশ্চিম দিকে এবং কিয়দাংশ পূর্ব দিকে চলে যায়। তারপর তারা প্রত্যক্ষ করতে থাকে যে, উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে কে এই পবিত্র রাতে ইবাদত বন্দেগীর মধ্যে নিমগ্ন রয়েছে। আর্‌ এই সকল ইবাদতগুজার বান্দাদের সঙ্গে ফেরেশতাগণ মুসাফাহ করেন এবং রাত্রি প্রভাত হওয়া পর্যন্ত ইবাদতকারীগণ করুণাময় আল্লাহপাকের দরবারে যে সকল মুনাজাত করেন উক্ত ফিরিশতাগণ তাদের সঙ্গে আমীন আমীন বলতে থাকেন। অন্য এক হাদীসে এসেছে, হযরত (সাঃ) বলেন-উক্ত তারিখে যে কেউ (মুসলমান) রাতে (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) জাগ্রত থাকবে, আমি তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবার যামিন থাকব।

 

তাফসীরে ইবনে কাসীর গ্রন্থে লিখা হয়েছে-এ রাতে সিদরাতুল মোনতাহায় অবস্থিত অগনিত ফিরিশতা সহ হযরত জিব্রাঈর (আঃ) দুনিয়ায় অবতীর্ণ হন এবং দুনিয়ার সমস্ত অংশে ছড়িয়ে পড়েন। প্রত্যেক স্থানে স্থানে সিজদা,রুকু করেন। মুমিন নর-নারীর জন্য দোয়ায় মশগুল হন। কিন্তু গির্জা ঘর ও মন্দির প্রতিমা, অগ্নি পুজার স্থানে, আবর্জনার স্তুপে এবং যে ঘরে নেশাখোর, বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতি থাকে সে ঘর হতে তারা দূরে সরে থাকেন।

এ রাতের ইবাদতে মশগুল প্রত্যেক মুমিনকে ফিরিশতারা সালাম করেন। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) তাদের সাথে মোসাফাহা করেন। শরীরের লোম খাড়া হয়ে যাওয়া, দিল নরম হওয়া, অশ্রু বহির্গত হওয়া ইত্যাদি তার মুসাফাহার আলামত। এ রাতে পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের রুহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে তাদের কবর যিয়ারত ও তাদের জন্য দোয়া করলে আল্লাহ কবুল করেন।

মহিমান্বিত রমজান মাসের বরকতময় রজনী ক্বদরের রাতটি মুসলিম জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই মুসলমান হিসেবে আমাদের কর্তব্য হল পবিত্র রমজান মাসে পরিপূর্ণ রূপে সিয়াম সাধনা পালন করতে হবে এবং শবে ক্বদরের যে মহা নেয়ামত আল্লাহ আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন তা থেকে যেন আমরা বঞ্চিত না হই। আর শবে ক্বদরে যে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে তার বিধান যেন আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে বাস্তবায়ন করি । আল্লাহ আমাদেরকে শবে ক্বদরের পূর্ণাঙ্গ ফজিলত দান করুন। আমীন!

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: