হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)

নবীদের পর উম্মতকুলে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা সর্বোচ্চ বলেই বিবেচিত হয়। আর সেই সাহাবিদের মধ্যে যাঁর নাম অগ্রগণ্য, তিনি হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)। তিনি মক্কার বিখ্যাত কোরাইশ বংশের বনু তাইম গোত্রে ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্য নাম আবদুল্লাহ ও ডাকনাম আবু বকর। সিদ্দিক হচ্ছে তাঁর উপাধি। মিরাজের ঘটনাকে সর্বপ্রথম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন বলেই রাসুল (সাঃ) তাঁকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন।

হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) মুসলিম জাহানের সর্ব প্রথম খলিফা। তাঁর খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সময়টি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তৎকালীন মুসলিম জাহানের বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা, ভণ্ড নবীদের উৎপাত, একদল লোকের জাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি ইত্যাদি দমনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন, 'আমি যত দিন আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের নির্দেশিত পথে চলি, তত দিন তোমরা আমাকে অনুসরণ করবে এবং আমাকে সাহায্য করবে। আর ভুল পথে চললে তোমরা আমাকে সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করে দেবে। তোমাদের মধ্যে যারা দুর্বল, তাদের হক আদায় না করা পর্যন্ত তারা আমার কাছে সবল ও শক্তিশালী। আর যারা সবল, তাদের কাছ থেকে হকদারের হক আদায় না করা পর্যন্ত তারা আমার কাছে দুর্বল।' সিদ্দিকে আকবর (রাঃ) প্রদত্ত এ ভাষণ দুনিয়ার সর্বকালের শাসকদের জন্য অনুপম আদর্শ।

সব সময়ই হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) কে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। তা ছাড়া মানুষের দুঃখ-দুর্দশায়, সহায়-সম্বলহীনতায় এবং দুস্থদের সাহায্যার্থে তিনি ছিলেন আত্মনিবেদিত। ইসলাম কবুল করার সময় হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর কাছে প্রায় ৪০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা জমা ছিল এবং তিনি সমকালীন ব্যবসায়ী বিত্তবানদের অন্যতম ছিলেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর সঞ্চয়কৃত সমুদয় অর্থ ইসলামের কল্যাণে তিনি রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাছে প্রদান করেন। তাবুকের যুদ্ধে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হলে যেখানে অন্য সাহাবিরা মোটা অঙ্ক দান করলেন, সেখানে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর কাছে দান করার তেমন কিছুই ছিল না। তাই তিনি ব্যাকুল চিত্তে ঘরে গিয়ে প্রয়োজনীয় আসবাব, কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে চুলার ছাই পর্যন্ত (যুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের ক্ষতস্থানে ছাই উপকারী) রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর দরবারে প্রদান করেন। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর এ ত্যাগ দেখে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য কী রেখে এসেছ?' তদুত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) কে।'

হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও সত্যনিষ্ঠ। সত্য ও ন্যায়ের ঝাণ্ডা পৃথিবীর জমিনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর যথাসর্বস্ব ত্যাগের মহিমা বিরল। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) কে জনৈক ব্যক্তি গালি দিলে বা মন্দ বললে তিনি জবাবে বলেছিলেন : যদি তুমি সত্যবাদী হও এবং আমি অপরাধী ও মন্দ হই, তাহলে আল্লাহ যেন আমাকে ক্ষমা করেন। পক্ষান্তরে যদি তুমি মিথ্যা বলে থাকো তাহলে আল্লাহ যেন তোমাকে ক্ষমা করেন। [কুরতুবি]। হুজুর (সাঃ) এরশাদ করেন, 'আমার উম্মতের মাঝে আবু বকরই বেশি দয়ালু।' নবী করিম (সাঃ) আরো বলেন, 'বন্ধুত্ব ও সাহায্য আবু বকরই আমাকে বেশি করেছিলেন। ইহজগতে যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে আবু বকরকেই করতাম।'

একদিন রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) হযরত আবু দারদা (রাঃ) কে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর আগে আগে চলতে দেখে সতর্ক করলেন এবং বললেন : তুমি কি এমন ব্যক্তির আগে আগে চলো, যিনি ইহকাল ও পরকালে তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ? তিনি আরো বলেন : দুনিয়ায় এমন কোনো ব্যক্তির ওপর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয়নি, যে পয়গম্বরদের পর হজরত আবু বকর থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ (রূহুল বয়ান)।

ইসলামের প্রতি হযরত আবু বকরের (রাঃ) অপরিসীম অবদানের জন্য তাঁকে 'ইসলামের ত্রাণকর্তা' বলা হয়। এ অবদানের স্বীকৃতির ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন, 'দুনিয়াতে আমি প্রত্যেক মানুষের এহসানের পরিপূর্ণ বদলা আদায় করেছি কিন্তু সিদ্দিকে আকবরের ত্যাগের প্রতিদান আদায় করতে পারিনি। হাশরের ময়দানে স্বয়ং রাব্বুল আলামিন তাঁকে ওই প্রতিদান দান করবেন।'

১৩ হিজরির ২২ জমাদিউস সানি মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ৬২ বছর বয়সে মহামান্য এই সাহাবি ওফাত লাভ করেন। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর রওজা মুবারকের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে হযরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর প্রত্যক্ষ সঙ্গী, রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) ও উম্মতের মাঝে সেতুবন্ধ রচনাকারী, কোরআনের নির্দেশ পালনে তিনি ছিলেন উন্মুখ। তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘটনা, কাজ ও বাণী আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। মুসলিম বিশ্বের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)-এর খেলাফতকালীন সোনালি দিনগুলোর কথা গভীরভাবে স্মরণ করা দরকার।

মহান আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে হুজুর (সাঃ) এর এই প্রিয় সাহাবির ফায়েজ লাভের তৌফিক দান করুন। আমিন।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: